শাহিদুর রহমান শাহিদঃ রাত ৯টা। উপস্থিত সবাই অপেক্ষা করছে কখন ঘন্টি পড়বে, কখন স্যার আসবে। ৯টা ৮ মিনিটে আবুল ভাই ঘন্টিটা বাজিয়ে দিল। সবাই স্যার আসছে স্যার আসছে চিৎকার করতে করতে হুড়োহুড়ি করে ক্লাস কক্ষের বেঞ্চে গিয়ে বসল। আমি বরাবরের মতই সবার পরই ক্লাসে ঢুকে শেষ বেঞ্চে বসলাম। ক্যাপ্টেন শামীম বরাবরেরই মতই হুমকি দিয়ে বলল তোরা সবাই খুব দুষ্টু। স্যারের কাছে তোদের নামে বিচার দিয়ে মাইর খাইয়ে নিব।
স্যার এল। ওহ হাঁ। বছরের প্রথম দিন, প্রথম ক্লাস এজন্য স্যার এল ২জন। হাহাহা। আমাদের ক্লাসে স্যার আসে ২জন। কেন? উত্তরটা আমি দেই। আমরা হচ্ছি স্পেশাল ৯৬। আমাদের স্যাররা এতই ভালবাসে যে, ২জন স্যার একসাথে ক্লাস নিতে আসেন। স্যারদের হাতে বেতও ছিল। এদিন স্যাররা আমাদের কাউকে কিন্তু বেতের ভালবাসা দেয়নি। ২ স্যার মিলে দেড় ঘন্টা টানা ক্লাস নিলেন। আমরাও মনোযোগ দিয়ে ছোট্ট শিশুর মতই ক্লাস করি। ক্লাস শেষে স্যাররা চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমন সময় স্যারকে বললাম স্যার, বছরের প্রথম দিন আমাদেরও প্রথম ক্লাস এজন্য আমরা একটু আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেছি। স্যার বলল কি বলিস? আমি বললাম জি স্যার। খাওয়া শেষে স্যার বলল পোলাও, খাসির মাংস, মুরগীর রোষ্ট, বড় রুই মাই এসবকে সামান্য আপ্যায়ন বলে? আমি বললাম স্যার আমরা স্পেশাল ৯৬। আমাদের কাছে এটা একটুই। স্যাররা আমাদের দোয়া করে দিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন। এ পর্যন্ত যা পড়লেন সব সত্যি। খালি একটু ভালবাসা যুক্ত করেছি।
এখন জানুন আসল ইতিহাস
————————
আমরা স্পেশাল ৯৬। রবার্টসনগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৯৯৬ সালের শিক্ষার্থী। গত ০১ জানুয়ারী আমরা আমাদের প্রাণের স্কুল রবার্টসনগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে আয়োজন করি বন্ধু মিলনির। গত ৩ মাসে ফেসবুক মেসেঞ্জার গ্রুপের মাধ্যমে আমাদের প্রায় ৮০ জন বন্ধুর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করি। বন্ধু শফিকের (ওরফে টাইগার) এর আমন্ত্রণে ০১ জানুয়ারী বন্ধু মিলনির সিদ্ধান্ত হয়। শুরু হয়ে যায় দৌড়ঝাপ। সরাসরি, মোবাইলে, মেসেঞ্জারে, ইমো, হটসআপ যে যেভাবে পেরেছে একে অপরকে সংবাদ জানিয়ে দেয়। দেশ বিদেশের সকলেই সাড়া দেয় আমাদের আয়োজনে। ৫ দিনের চেষ্টায় আমার প্রস্তুত বন্ধু মিলনির।
চির স্মরণীয় ০১-০১-২০২১ শুক্রবার
সকালে ঘুম থেকে উঠেই নাস্তা না করেই বেড়িয়ে পরি। মোটরসাইকেল চালানোর সময় হেলমেডের চিপায় ফোন ঢুকিয়ে কথা বলি তিতাস, সাজেদুল ও শফিকের সাথে। ১০ টায় হাজির হই রবাটসনগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। সবাই একত্রিত হয়ে স্টেশন বাজারে যাই। বাজার সদাই এনে বাবুর্চিকে বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে আসি জুম্মার নামাজ পড়তে। নামাজ শেষে বিকেল ৩টায় আবারো ছুটে যাই আমাদের প্রাণের স্কুল রবার্টসনগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। স্কুলে ঢুকতেই কেমন যেন লাগছিল। বুঝাতে পারবোনা। এই অনুভুতিটা বলে আসলে অন্তত আমি বুঝাতে পারবোনা। কবি সাহিত্যিকরা পারলেও পারতে পারে। বিকেল থেকেই বন্ধুরা আসতে শুরু করে। একে একে রাত অবদি আসে ৩৬ জন বন্ধু। ২ জন স্যার। ২ জন অফিস সহকারী। মাগরিবের আযানের আগ পর্যন্ত চলে কোলাকুলি, নাচানাচি, গান ও হইহুল্লোর করে। বন্ধু রাজুর গানতো সেই মজা হয়েছে।
২৪ বছর পর
———–
চোখ বন্ধ করুন। চোখ বন্ধ রেখে ২ মিনিট অপেক্ষা করুন। চোখ বন্ধ রেখে ৩ মিনিট ভাবুন যে ২৪ বছর পর আপনার সামনে কোন বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে। কি হবে ভাবতে পারেন। হুম আপনি যা ভাবছেন, তাই হয়েছে। লাভ লাভ লাভ ১০০% ভালবাসা প্রকাশ পেয়েছে সেদিন। নাচ, গান, হইহুল্লোর, কোলাকুলি, কেককেটে, পিকনিক করে দিনটি উদযাপন করি আমরা।
ঘন্টির জন্য অপেক্ষা
—————–
নির্দিষ্ট সময়ের একটু পরেই ঘন্টি পড়ে। আমরাতো আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলাম ঘন্টির। ক্যাপ্টেন শামিমের নেতৃত্বে শুরু হয় শুভেচ্ছা বিনিময়। বন্ধু মঈনের মেয়ে আমাদের সবাইকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানায়। বন্ধু খালেকের পোক্ত কথামালার পরিচালনায় শুভেচ্ছা কথার শুরুতেই মঈন, মিজান ও মাসুমের শুভেচ্ছা কথা সকলের ভিতরে তোলপাড় করে দেয়। আমার চোখের কোনে নোনা পানিও চলে আসে। কাউকে দেখতে দেইনি। কেননা আমিতো ছিলাম শেষ বেঞ্চ এ। সবাই স্তব্ধ হয়ে শুনে মাসুমের বন্ধুদের উদ্দেশ্যে হৃদয় নিংড়ানো কথামালা। এবার আমার পালা।
স্পেশাল ৯৬ এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
—————————-
বন্ধু মমিনুলের সাথে ২৪ বছর পর দেখার হবার অনুভুতি থেকেই শুরু করি রবার্টসনগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৯৯৬ ব্যাচের ফেসবুক মেসেঞ্জার গ্রুপ। প্রথম দিনই যুক্ত করি ১৪ জনকে। সকলকে অনুরোধ জানাই সকল বন্ধুদের খুঁজে বের করতে। আজ যুক্ত আছে ৬০ জন। এছাড়াও আমাদের সাথে যোগাযোগ আছে আরও ২০ জনের। অনেকই আছে বিদেশে। কেউ কেউ আছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। আরও কিছু বন্ধুকে এখনও খুঁজছি। ঠিকই খুঁজে বের করব একদিন। ইতিমধ্যেই আমরা তিস্তার চরাঞ্চলের শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরন করেছি। আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য সারাজীবন রবার্টসনগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের সাথে থাকা। এলক্ষে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি রবার্টসনগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৯৯৬ ব্যাচের পক্ষ থেকে বৃত্তি চালু করা। যার প্রস্তুতির কার্যক্রম আমরা শুরু করেছি। ইন্শআল্লাহ এ বছর থেকেই আমরা বৃত্তি চালু করব। যা থেকে উপকৃত হবে রবার্টসনগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী।
বন্ধু বিহীন একটি দিনও নয়
————————
আগেই বলেছি আমাদের ক্লাস নিতে আসেন ২ জন স্যার। আমাদের প্রিয় হেড স্যার (বর্তমানে অধ্যক্ষ) জাকির হোসেন স্যার ও সামসুল স্যার।
জাকির হোসেন স্যার
——————
স্যার, আমাদের আয়োজন দেখে এতটাই খুশি ও মুগ্ধ হয়েছেন যে, নিঃসংকোচে বলেই ফেললেন সবাইকেই ছেড়ে থাকা সম্ভব, কিন্তু বন্ধু বিহীন একটি দিনও নয়। তিনি আমাদের জন্য দোয়া করেন এবং সফলতা কামনা করেন।
প্রিয় সামসুল স্যার
—————
২৪ বছর থেকে জমানো ভালবাসার কথামালায় আমাদের ভাসিয়ে দেন আমাদের প্রিয় সামসুল স্যার। আমরা স্তব্ধ হয়ে শুনতেই থাকি, শুনতেই থাকি স্যারের কথা। স্যারের কথাগুলো আমৃত্যু মনে থাকবে বন্ধুদের। রাতও গভীর হতে থাকে, পেটের ক্ষুধাও বাড়তে থাকে পাল্লা দিয়ে। অবশেষে সবাইমিলে খাওয়া শেষে বিদায় নেই। আল্লাহ হাফেজ।
কৃতজ্ঞতা :
———
জাকির স্যার, সামসুল স্যার, মাজেদুল স্যার, জয়নাল স্যার, বনমালি স্যার ও আফজাল স্যার।
আবুল হোসেন ও বাবলু ভাই
কৃতজ্ঞতা সকল বন্ধুদের প্রতি
ধন্যবাদ :
——–
আমার সহকর্মী ফুয়াদ, নুর মোহাম্মদ ও লিটন।
জয় হোক স্পেশাল ৯৬ এর
লেখকঃ শাহিদুর রহমান শাহিদ
এসএসসি ৯৬ ব্যাচ
রবার্টসনগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়, রংপুর