চিঠির যুগ এখন আর নেই। প্রেম ভালোবাসা টিকে আছে মুঠোফোনে। চিঠির জন্য, প্রিয় মানুষের প্রিয়মুখ দেখার সেই করুণ তীব্র অপেক্ষায় থাকতে হয় না কাউকে। পথের ধুলোয় একাকার হয় না নিমগ্ন দুপুর। প্রিয় মানুষের বিশেষ দিনগুলো মনে রাখবার বালাই নেই কারোর। আর জন্মদিন সে তো দায়িত্ব নিয়ে জানিয়ে দেয় জাকারবার্গের ফেসবুক। আমাদের বাপদাদারা পরম যত্নে ডায়েরির পাতায় লিখে রাখতেন বাংলা, ইংরেজি, আরবি তারিখসহ। একটা সময় দেখা যেত দেয়ালে টাঙ্গিয়ে রাখা হতো নামধামসহ জন্মতারিখটি।
বয়স চুরির সার্টিফিকেটে বাংলাদেশের প্রায় সবার দুটো জন্মদিন। মাতৃগর্ভ থেকে প্রস্থান এবং সনদপত্রীয়। গত ২৩ ডিসেম্বর ছিলো আমার একজন প্রিয় মানুষের জন্মদিন। সেদিন জন্মদিন উপলক্ষে বহুদিনের পুরনো সেই লাটিম বইটি হাতে নিলাম। ক্লাস ফোর কিংবা ফাইভে প্রথম পড়েছিলাম বইটি। বইয়ের ফ্ল্যাপে তার জন্মতারিখ দেখে চমকে পেলাম। সেই ফেসবুক ২৩ তারিখ বললেও বইয়ে ১০ তারিখের কথা। সঙ্গে সঙ্গেই ফোন দিয়ে বললাম, ভাই দু’জায়গায় দু’রকম ডেট।
সেদিন বুঝতে পারলাম বয়স চুরির সার্টিফিকেটের জন্মতারিখ ব্যবহৃত হয়েছে তার বইয়ে। সনদপত্রীয় জন্মতারিখটিও যে পালন করা যায় সেটা ভাইয়ের কথায় আঁচ করতে পারলাম।
আবিদ করিম মুন্না, সম্পর্ক ছোটবেলা থেকেই। দুজনের পিতাই শিক্ষক। শহরের দুইটি শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠের। সেদিক থেকে আমাদের মিল আর সম্পর্কের গভীরতা। মনে পড়ে সেই ২০০৬/২০০৭ সালের কথা। আমাদের বাসার সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আব্বুকে বলেন, চাচা বাম পা আগে দিবো নাকি ডান পা। শৈশবে এরকম কথা সবাইকে আনন্দ দিতো। সেভাবেই মনে রেখেছিলাম মুন্না ভাইকে। তারপর একে একে তার লাটিম, এক সেকেন্ডের ঘুম, প্রিয় রাইয়ান বইগুলো পড়েছিলাম। বইয়ের অটোগ্রাফে তার সুন্দর হাতের লেখা নজর কেড়েছিলো।
সর্বশেষ ২০১৮ সালে ঢাকায় মেজো ভাইয়ের হলে থাকা অবস্থায় সিদ্ধান্ত নিলাম বাংলা একাডেমিতে নিজের চরণধুলি দিয়ে আসি। একাডেমির মাঠে ঢুকে একজন কেয়ার টেকারকে জিগ্যেস করলাম, মুন্না ভাই কোথায় বসেন? প্রতি উত্তরে বললেন, আপনি রংপুর থেকে এসেছেন নাকি? আমার হ্যাঁ বাচক উত্তর শুনে দেখিয়ে দিলেন সঠিক গন্তব্য। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে ভাবছিলাম নিজ শহরের প্রতি ভালোবাসা থাকলে চারপাশের মানুষও বুঝতে পারে।
সেদিন আফসোস করে মুন্না ভাই তার সম্পাদিত স্টেথোস্কোপ রেখে কিবোর্ড বইটিতে লিখে দিলেন, ‘দুঃখ থেকে গেল এই বইতে তুমি নেই… আগামীর জন্য শুভেচ্ছা ডা. খালিদ সাইফুল্লাহকে। ‘ সেদিন তার পাশে বসিয়ে চা বানিয়ে খাওয়ানো। দুই ভাই মিলে বিস্কুট চানাচুর খাওয়ার উপভোগ্য সময়টুকু জানান দিচ্ছিলো আমরা যান্ত্রিক শহর ঢাকায় নয় রংপুরেই আছি।
আমার প্রতিটি লেখা চোখে পড়লেই ইনবক্সে কিংবা ফোনে জানিয়ে দেন, এই কবিতার এই বানানটা ভুল। দরকার হলে অভিধান দেখে মিলিয়ে নাও। রংপুরে আসলেই আমাদের গলির মুখে সেলফি বিরতি দেওয়া মুন্না ভাইয়ের পছন্দের একটি কাজ। ১০/২০ সেকেন্ডের ঐ বিরতিতে ঐটুকু ভালোবাসা হয়তো বুঝেন না ব্যস্ত অটোওয়ালা। তাই বিরক্তির চিন্হ ফুটে উঠে তার চোখেমুখে। সদাহাস্যজ্বল মুন্না ভাই ফিরে যান আবারও।
বাবা মা চেয়েছিলেন ছেলে ডাক্তার হবে কিন্তু খুব অল্প নম্বরের জন্য চাম্স পাননি স্কুল কলেজের মেধাবী ছাত্র মুন্না।যদিও তিনি ছিলেন প্রকৃতি প্রেমিক,সহজ সরল প্রকৃতির তাই হয়তো পেয়েছিলেন এক নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ক্যাম্পাস।বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু তবুও মেডিকেলের প্রতি তার দুর্বলতা কমেনি।
অধ্যাপক পিতার সন্তান এবং নিজস্ব প্রেস থাকায় রংপুরের সব খ্যাতিমান কবি,সাহিত্যিক,সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের পদচারণায় কেটেছে তার শৈশব। স্বভাবতই সাহিত্যের প্রতি তার ভালোবাসা সেই ছেলেবেলা থেকেই। যদিও বাবা মা চাননি তিনি লেখক হন।কিন্তু প্রতিভা,ভালোবাসা কি দমিয়ে রাখা যায়? তাই হয়তো প্রকৃতির চাওয়াই এখন তার জীবনযাপন। ডাক্তার কিংবা কৃষিবিদ্যা সবকিছু কে ছাপিয়ে তিনি একজন সম্পাদক। বাংলা একাডেমির সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
লাটিম ছিলো তার প্রথম বই। গল্পের ছলে শৈশব, কৈশোর, প্রিয় শহর রংপুর কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনকে তুলে এনেছেন সহজ সরল শব্দে। লেখালেখির প্রতি যার অবদান ছিলো সবচেয়ে বেশী।সেই তৈয়বুর রহমান বাবুর প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে উৎসর্গ করেছেন প্রথম বইটি,লাটিম। কখনো তিনি নিজেকে উপস্থাপন করেছেন কখনোবা চরিত্র দিয়ে গল্প সাজিয়েছেন। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে তার গোপন ডায়েরি হাতে পেয়েছি। রংপুরের বিভিন্ন গুণিজনের কথা যেমন তুলে ধরেছেন তেমনিভাবে তার জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে যাদের সংস্পর্শে থেকেছেন তাদেরকে তুলে আনার চেষ্টা ছিলো গল্পের ভিতরে।
আবিদ করিম মুন্না ভাই সদালাপী, হাস্যরস, বিনয়ী একজন মানুষ। মলাট বন্দী হয়েছে তার তিনটি গল্প গ্রন্থ- লাটিম, এক সেকেন্ডের ঘুম এবং দাগ। রংপুরের স্বনামধন্য প্রকাশনী পাতা প্রকাশ থেকে বেরিয়েছে তার সম্পাদিত দুটি বই। প্রথমটির নাম ‘তিস্তাপারের গল্প’ এবং দ্বিতীয়টি ‘স্টেথোস্কোপ রেখে কিবোর্ডে’। এই বইটি ছিলো একবারেই ভিন্নধর্মী বই।ডাক্তার কিংবা মেডিকেল পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের লেখা নিয়ে সম্পাদিত বইটি জানান দেয় মেডিকেল, ডাক্তারদের প্রতি তার ভালোবাসা। হয়তো পিতার সেই আক্ষেপের যায়গাটা একটু হলেও চেষ্টা করেছিলেন। আরেকটি ব্যতিক্রমধর্মী কাজ তিনি করেছিলেন। সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তার সহধর্মিণী রাবেয়া সরকার রত্না।দু’জন মিলে সম্পাদনা করেছেন ‘প্রিয় রাইয়ান’। দেশের খ্যাতিমান ছড়াকারদের ছড়া নিয়ে সংকলিত বইটি তার সন্তানের জন্য এক অনন্য পুরস্কার। তেমনিভাবে বাবাদের জন্য দৃষ্টান্ত। বাবার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে প্রয়াত বাবার জন্য কাজ করছেন একটি স্মারকগ্রন্থের।
মাতৃগর্ভ থেকে প্রস্থান দিবসের মতোই পালিত হোক মানুষের সনদপত্রীয় জন্মদিন। প্রিয় মানুষের বিশেষ দিনগুলো টুকে রাখা হোক ডায়েরির পাতায়। এই শুভদিনে শুদ্ধ মানুষ মুন্না ভাইকে জানাই অকৃত্রিম ভালোবাসা। আমি যেমন মুন্না ভাইকে ভালোবাসি তেমনি তিনি স্নেহ করেন আমায়। যে কয়েকজন মানুষ পর্দার আড়াল থেকে আমাকে গাইডলাইন দিয়ে যাচ্ছেন তাদের প্রধানতম ব্যক্তি মুন্না ভাই।
ভালো থাকুক মুন্না ভাই, ভালো থাকুক সব প্রিয়জন।