**রংপুর নাগরিক সমাজ(RNS) সংগঠনের নিউজ পোর্টাল rnsnews24.com এ স্বাগতম।  *** প্রতিনিধি নিয়োগ*** রংপুর বিভাগের সকল জেলা ও রংপুর জেলার সকল উপজেলায় প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে। যোগাযোগ- 01722-882770 ।  *** সবার আগে নির্ভুল সংবাদ পেতে নিয়মিত ভিজিট করুন।
শিরোনাম :
প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে খুলনায় দেশীয় তামাক চাষীদের মানববন্ধন   রংপুরে প্রাইম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৬ শতাধিক চিকিৎসক নিয়ে ডক্টরস নাইট অনুষ্ঠিত জাতীয় বডি বিল্ডিংয়ে মিষ্টার বাংলাদেশ কে এই রংপুরের আহসানুল হক রংপুরে দুই পুলিশ কর্মকর্তার নেতৃত্বে বাড়ি দখলের চেষ্টার অভিযোগ রংপুর সিটি নির্বাচনে আ’লীগের মেয়র প্রার্থী ডালিয়া উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা হাজ্জাজের বঙ্গবন্ধু ম্যুরালে শ্রদ্ধাঞ্জলী কেন্দ্রীয় অনুমোদন পেল সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট রংপুর জেলা কমিটি জাল দলিল করে জমি আত্মসাৎ করার ঘটনায় লিপি খান-শিমুল ভরসাসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা রংপুরে বিদেশে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে বিশেষ আলোচনা রসিক স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী মিলনের নির্বাচনী ওয়ার্ড কার্যালয়ের উদ্বোধন

রংপুরে ঠাকুর পঞ্চানন বর্মাঃ রেজাউল করিম মুকুল

রংপুরে ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা

রেজাউল করিম মুকুল

“ছিড়িয়া গলার দড়ি, ক্ষতিচিহ্ন লুপ্ত করি,
প্রাণভয়ে ইতি উতি পলান্ত সকলি সংগ্রামক ভয় করি,
ভঙ্গক্ষত্রি নাম ধরি, আপনাকে মানে কেহ রাজবংশী বুলি।
বর্ধণসূত পাঁচজন রত্নপিঠে নিল থান
আর কেহ লুকাইল যোনীগর্ভ পিঠে।”
মাথাভাঙ্গার শিতলখুচি নিবাসী খাঁ চৌধুরী আমানতউল্লাহ রচিত কোচবিহারের ইতিহাস গ্রন্হে উল্লিখিত হোয়েছে, শঙ্করদেবের(শঙ্করাচার্য) শিষ্য ষোড়শ শতাব্দীর পন্ডিত রুপনারায়ন শ্রুতিধর রচিত কামতেশ্বর কুলকারিকায় আছে- বর্তমান রংপুরের পূর্বনাম ছিলো কামরুপ বা কামতাপুরি। পরশুরামের ভয়ে যারা ক্ষত্রিয়াচার পরিত্যাগ করে রত্নপিঠ বা রংপুরে আশ্রয়গ্রহণ করেছিলেন তারাই রাজবংশী বা কোচ নামে খ্যাত হয়েছিলেন।
খাঁ চৌধুরী আমানতউল্লাহ আহমদ তার কোচবিহারের ইতিহাস গ্রন্হে লিখেছেন, হৈহয়বংশীয় জনৈক ক্ষত্রিয় থেকে জগদ্দীপেন্দ্রনারায়ন ও ইন্দ্রজীৎনারায়ন পর্যন্ত ২২ জন রাজা কিংবা মহারাজা কোচবিহার রাজ্যটি শাসন করেছেন। দরং রাজবংশাবলী আসাম বুরুঞ্জিতে কোচরাজাদের রাজবংশী উল্লেখ করা হোয়েছে। ১৯১৪ খ্রিঃ কবি ঘণশ্যাম দলাই কামতা কোচবিহার রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজা বিশ্বসিংহকে প্রথম ক্ষত্রিয়জাত বলে উল্লেখ করেছেন। বিশ্বসিংহ পরে হিন্দু শাস্ত্রমতে শৈবধর্মে দিক্ষা নেন বলে জানা যায় এবং তিনি কনৌজ, কাশি, প্রভৃতি রাজ্য থেকে ব্রাক্ষ্মণদের কোচবিহারে এনে বসতি করে দেন। এরকমটি আমরা পাল রাজাদেরও করতে দেখেছি যারা বিজয়সেনদের সুদুর কর্ণাটকা থেকে গৌড়ে এনে বাসস্হান করে দিয়েছিলেন যারা পরবর্তিতে গোটা বাংলাই দখল করে নেয়। এক প্রতিকুল রাজনৈতিক সামাজিক আবহাওয়া পরিমন্ডলে কোচবিহারে অভূত্থান ঘটেছিলো এক ক্ষণজন্মা ব্যাক্তিত্বের যিনি প্রতিটি পদে পদে তার নিজের জীবন বাজি রেখে আমাদের জন্যে রেখে গেছেন বর্ণবৈষম্য, অবহেলা আর অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলণ সংগ্রামের এক দীর্ঘ ইতিহাস। তিনি কখনই মাথা নোয়ান নাই। প্রতিটি পদে পদে প্রতিবাদ করে গেছেন অনেকটা একাই, শাস্তিও ভোগ করেছেন একাই। নিজ জন্মভূমি থেকে নিছক সন্দেহের বলি হয়ে বিতারিত হোয়েছেন। হ্যা আমি ঠাকুর পঞ্চানন সরকারের কথাই বলছি। তিনি তার সময়ে কতটা মেধাবী মানুষ ছিলেন তা আপনারা সবাই জানেন। ১৮৬৬খ্রিঃ মাথাভাঙ্গায় জন্ম নেয়া পঞ্চানন সরকার ১৮৮৫খ্রিঃ মধ্য ইংরেজি, ১৮৮৯খ্রিঃ কোলকাতা থেকে এন্ট্রাস, ১৮৯১খ্রিঃ বঙ্গবাসী কলেজ থেকে এফএ(ফাষ্ট আর্টস), ১৮৯৩খ্রিঃ সংস্কৃত সাহিত্যে বিএ, ১৮৯৬খ্রিঃ এমএ এবং ১৯০০খ্রিঃ কোলকাতা রিপন কলেজ থেকে বিএল পাশ করার পরে কোচবিহারে একটি সরকারি চাকুরির আবেদন করেছিলেন। সে সময় উচ্চবর্ণের কতিপয় কর্মকর্তার আপত্তির কারণে ইংরেজ রেসিডেন্ট পঞ্চানন সরকারের প্রয়াজনীয় যোগ্যতা থাকা সত্বেয় তার আবেদন খারিজ করে দেন্। সে সময় তার সমতুল্য অন্য কোন প্রার্থীই ছিলো না। কেবলমাত্র নিম্নবর্ণ মন্তব্য করে তার আবেদন খারিজ করে দেয়া হয়।
হিন্দু সমাজের শ্রেণি বৈষম্য ঠাকুর পঞ্চনন বর্মণ এর ক্ষত্রিয়ায়ন আন্দোলনের পালে বাতাস দিয়েছিলো একেবারে শুরুতেই এবং পঞ্চাননের সঠিক নেতৃত্ব সে আন্দোলনকে বেগবান করেছিলো তিনি কোচবিহার রাজ্য থেকে বহিস্কৃত হয়ে রংপুরে আগমনের পরে। ১৯৩১খ্রিঃ আদমশুমারি অনুযায়ী তৎকালিন রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, জলপাইগুড়ি, মালদহ, বিহার ও আসাম অঞ্চলে রাজবংশী ছিলো ১৮,০৬,৩৯০জন আর এক কোচবিহারে ১৯২১ খ্রিঃ এর শুমারী অনুযায়ী রাজবংশী মানুষের সংখ্যা ছিলো ১৭,২৭,২১১জন। এদের নব্বই ভাগের বাস ছিলো উত্তরবঙ্গ। রাজবংশীদের অসন্তোষ ও আন্দোলণের আর একটি বড় কারণ ছিলো আদমশুমারীগুলোতে কোচ, মেচ, খেন, পলিয়াদেরও রাজবংশীদের সাথে এক করে গণনা করা হতো। রাজবংশীজাতি হিসেবে এটাও ছিলো একধরণের অপমান ও অবজ্ঞা। ১৮০৭-১৮০৯ খ্রিঃ ফ্রান্সিস বুকানন হ্যামিল্টন সাহেব লিখেছেন, নৃকুলবিদ্যার বিচারে এরা সবাই একই জাতিগোষ্ঠির মানুষ। তিনি লক্ষ্য করে দেখেছেন অনেক কোচ, পলিয়া বা খেনরা নিজেদের রাজবংশী পরিচয় দিতেন। এবং নিজেদের ক্ষত্রিয় বলে দাবী করেছেন। রংপুর অঞ্চলে এ বিষয়ে একটি পৌরাণিক কাহিনীর প্রচলন আছে। যারা পরশুরামের ভয়ে পালিয়ে এসেছে তারাই পলিয়া এবং যারা রণে ভঙ্গ দিয়ে এসেছে তারা ভঙ্গক্ষত্রিয়। তবে এরা উভয়ই ক্ষত্রিয় এবং এরা তিস্তা-করতোয়া-ব্রক্ষ্মপূত্র নদীর অববাহিকায় বসতি গড়ে তোলে। কোথাও কোথাও এদের ব্রাত্য ক্ষত্রিয় বলা হয়। গবেষকগণ প্রায় সবাই এদের একই জাতির ভিন্ন ভিন্ন নামকরণ হিসেবে একমত হোয়েছেন। অনেক কোচ বংশীয় রাজাকে রাজবংশীরা নিজেদের বংশের বলে দাবী করেছেন।
ঠাকুর পঞ্চানন বর্মণ ১৯১০খ্রিঃ রংপুরে অনুষ্ঠিত এক মহাসম্মেলনে যে ক্ষত্রিয় সমিতি গঠন করেন তার প্রধান কার্যালয় বর্তমান রংপুর বিভাগীয় শহরের প্রানকেন্দ্রে সেই বর্ধণকোট রাজবাড়ি থেকে মাত্র অর্ধ মাইল দুরেই অবস্হিত। পঞ্চানন বর্মণ প্রতিষ্ঠিত সেই আদি ক্ষত্রিয় সমিতি কার্যালয়ের পাশের রাস্তাটির নামকরণ করা হোয়েছে পিবি রোড (পঞ্চানন বর্মা রোড)। পঞ্চানন বর্মা রংপুরে তার সময়ের হিন্দু-মুসলমান সব ধর্মের মানুষের কাছে ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় একজন গুণি মানুষ এবং রংপুর জজ কোর্টের একজন স্বনামধণ্য আইনজীবী।
১৯০৫ খ্রিঃ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগ্রহে এবং প্রস্তাবনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কোলকাতা এর প্রথম শাখাটি স্হাপিত হয় সাহিত্যের সুমহান ইতিহাস ঐতিহ্যে মহিয়ান এই রঙ্গপুরে। তখন থেকেই নিয়মিত প্রকাশিত হোতে থাকে ত্রৈমাসিক “রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা।” রংপুরে সদ্য আগত পঞ্চানন বর্মা সাহিত্য ও গবেষণায় এতটাই সিদ্ধহস্ত ছিলেন যে তিনি দীর্ঘ আট বছর এ রকম একটি গবেষণাধর্মী পত্রিকা সম্পাদনা করার সুযোগ পান। এ পত্রিকাটির কপি কোলকাতায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছেও পাঠানো হতো। এছাড়া তিনি ক্ষত্রিয় নামে একটি মাসিক পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ করতেন রংপুরে থেকে।
পঞ্চানন বর্মণকে কোচবিহার রাজ্য থেকে কেন কি অপরাধে বহিষ্কার করা হয়েছিলো সে সম্পর্কে মানুষের কাছে ভুল বার্তা পৌছে দেয়া হয়েছিলো সে সময়। সমাজ সংস্কারক রায় সাহেব ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা ১৯০৯-১৯১০খ্রিঃ অবিভক্ত বাংলার বর্তমান বাংলাদেশের উত্তরের জনপদ রংপুরে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠা করেন আজকের স্বনামধন্য ক্ষত্রিয় সমিতি। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪২খ্রিঃ কোচবিহারে প্রতিষ্ঠা পায় আজকের কোচবিহার ক্ষত্রিয় সমিতি। রায়সাহেব পঞ্চানন বর্মা (১৮৬৬-১৯৩৫) গত বিংশ শতকের গোড়ায় রংপুরে এসে উত্তরবঙ্গের পিছিয়ে পড়া, দীর্ঘদিনের অবহেলিত রাজবংশী মানুষদের মধ্যে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেন। গভীর ইতিহাস চর্চার মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেন রাজবংশীরা বীরের জাতি, যোদ্ধা সম্প্রদায় ক্ষত্রিয়। তিনি সারা ভারতের বিদগ্ধ জ্ঞানীগুণী পন্ডিত সমাজকে বোঝাতে চেষ্টা করেন রাজবংশীরা ইঙ্গ-মঙ্গোলয়েড নয়, রাজবংশীরা ইঙ্গ-এরিয়ান, আর্য ভাষাগোষ্ঠী, আর্যজাতিধারার অংশ। বহিরাগত আক্রমণের ফলে ক্রমান্বয়ে যারা হয়ে যায় দলিত, পতিত। পঞ্চানন বর্মা রাজবংশী সমাজকে পুনরায় বিক্রমশালী ক্ষত্রিয়ত্বে উন্নীত করেন। মন্ত্রোচারণের মধ্য দিয়ে রাজবংশী সম্প্রদায়কে তিনি বীর ক্ষত্রিয়দের ন্যায় উপবীত ধারণ করান। তিনি ১৯৩২ সায়মন কমিশনের গোলটেবিল বৈঠকে অংশ গ্রহণ করে রাজবংশীদের Backward class ইংরেজী ভাসায় যে বক্তব্য রাখেন তা তৎকালিন রাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম গ্রিন্টিসকে অভিভুত করে।পরে পঞ্চাননের আবেদনে ১৯৩৩খ্রিঃ ১৬ জানুয়ারি তৎকালিন ইংরেজ সরকার রাজবংশীদের Dipressed class থেকে Schedule caste হিসেবে তালিকাভূক্ত করেন।সে বছরই বাংলায় তপসিলি জাতির তালিকায় রাজবংশীদের নাম অন্তর্ভূক্ত হয়। ১৯৫০ ও ১৯৫৬খ্রিঃ ভারতীয় সংবিধানের ৩৪১ ধারায় বণিত Schedule caste হিসেবে তালিকাভূক্ত রাজবংশীরা আজ শিক্ষা, ব্যবসা, চাকুরিসহ বহুবিধ ক্ষেত্রে যে সুবিধা ভোগ করেন তার একক কৃতিত্ব রাজবংশী জাতির নব রুপকার পঞ্চানন বর্মণের।এসব যদিও পঞ্চানন বর্মণের ক্ষত্রিয়ায়ণ আন্দোলণের পরিপন্হি তবুও পঞ্চানন বর্মার কঠোর আত্মত্যাগের পরিনাম ছিলো সুদূরপ্রসারি। মূলতঃ কোচবিহার ও শিলিগুড়ির রাজবংশীরা আজ ক্ষত্রিয় মর্যাদার পাশাপাশি প্রায় সবকিছুতেই সংরক্ষিত সুবিধার আওতায় এসেছেন এমনকি বিধানসভা ও লোকসভার আসনে ভোটপ্রার্থী হিসেবেও সংরক্ষিত আসন তালিকাসহ প্রকাশিত হয়। জাতির প্রতি এই অবদানের স্বরূপ তিনি মানুষের চোখে আদৃত হন ঠাকুর নামে। তিনি তার নিজের নামের সাথে যোগ করে নেন বর্মা। উত্তরপূর্ব ভারতের নবজাগরণের রূপকার পঞ্চানন বর্মার মহাপরি নির্বাণ হয় কোলকাতায় ১৯৩৫ সালে আজকের এই ৯ সেপ্টেম্বরে। তার বিদেহী আত্মা শান্তি পাক পৃথিবীতে তার রেখে যাওয়া হাজারো লাখো অনুসারীর শুভ কামনায়।

রেজাউল করিম মুকুল, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১খ্রিঃ রংপুর, বাংলাদেশ।

সংবাদটি সবাইকে জানাতে আপনার স্যোস্যাল অ্যাকাউন্ট দিয়ে শেয়ার করুন




©২০২২ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। আর এন এস নিউজ ২৪.কম।